মধু খুব স্বাদময় এবং শরীরের জন্য একটি উপকারী খাদ্য। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও শীতকালে শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য আমরা মধু সেবন করে থাকি। মধু একটি উপকারী ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই মধু প্রক্রিয়াকরণ মেশিনের সাহায্যে মধু শোধন করে তা বোতলে ভরে আপনি বাজারে বিক্রি করতে পারেন।
বাজারে অনেক ভালো ভালো ব্রান্ডের মধু পাওয়া যায়। তাই এইসব কোম্পানির সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা জমাতে গেলে আপনাকে মধুর গুণগত মানের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তবে আপনার কোয়ালিটি ভালো হলে বাজার তৈরি করতে বেশি সময় লাগবে না। প্রথমত আপনাকে আপনার লোকাল মার্কেট ও এলাকায় এই মধু বিক্রি করে বিশ্বস্ততা অর্জন করতে হবে এবং ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়াতে হবে।
কাঁচামাল:
এর জন্য প্রধান দরকারী কাঁচামাল হল অপ্রক্রিয়াজাত মধু, যা সরাসরি মৌচাক থেকে পাওয়া যায়। এই মধু আপনি গ্রামীণ অধিবাসী থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়া আপনি সব থেকে ভালো মধু মৌমাছির ফার্ম থেকে পেয়ে যাবেন।
এই মৌমাছির চাষ বা মৌমাছি প্রতিপালন আপনি নিজেও করতে পারেন। এর জন্য বেশি খরচ ও পরিশ্রম করতে হয় না। আসুন মোটামুটিভাবে এই মৌমাছি প্রতিপালন সম্বন্ধে জেনে নিই।
মৌমাছি পালনের বাক্স :
এ মৌমাছির বাক্স সাধারণত কাঠাল কাঠের তৈরী এবং ২৮.৬ সে.মি x ২৭.৭ সে.মি x ১৭.৪ সে.মি মাপ বিশিষ্ট হয়। এর নিচের দিকে খোলা, যা একটি কাঠের পাটাতনের উপর বসানো থাকে। বাক্সের উপর কাঠের একটি ঢাকনা থাকে। ঢাকনার নিচে সাতটি সমান্তরাল কাঠের ফ্রেম থাকে । এ মৌমাছিরা চাক বাঁধে। এ প্রকোষ্ঠের উপর ফ্রেমসহ আরেকটি প্রকোষ্ঠ বসানো থাকে। উপরের প্রকোষ্ঠকে মধু প্রকোষ্ঠ ও নিচের প্রকোষ্ঠকে বাচ্চা প্রকোষ্ঠ বলে। যে স্থানটি অপেক্ষাকৃত উচু, নির্জন, ধোয়া অথবা গ্যাসমুক্ত, শুকনো এবং ছায়াযুক্ত এবং আশে-পাশে পর্যাপ্ত ফুল সমৃদ্ধ গাছ-গাছড়া আছে সেখানে মৌমাছির বাক্স বসাতে হয়।
মৌমাছি সংগ্রহ ও কৃত্রিম খাবার :
প্রকৃত থেকে ভারতীয় মৌমাছি (রাণী ও কিছু শ্রমিক) সংগ্রহ করে অথবা প্রতিষ্টিত মৌচাষীর নিকট থেকে ক্রয় করে মৌচাষ কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়। বাক্সবন্দীর প্রথম ৩/৪ দিন কৃত্রিম খাবার যথা চিনির ঘন সরবত বা সিরাপ দেবার প্রয়োজন হয়। এরপর মৌমাছিরা নিজেদের খাবার নিজেরা সংগ্রহ করে থাকে। কখনো কখনো পরিবেশে খাবার ঘাটতি পড়লে ও কৃত্রিম খাবার দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
মৌমাছির উপযোগী গাছ-পালা :
মৌমাছির জন্য ফুলের মিষ্টি রস ও পরাগরেণু সমৃদ্ধ গাছ-পালার প্রয়োজন। সারা বছর মিষ্টি রস ও পরাগরেণু সমৃদ্ধ ফুল প্রাপ্তি যাতে নিশ্চিত হয়, সেজন্য নিম্নলিখিত গাছ-পালা মৌমাছি এলাকার আশে-পাশে (২/৩ কিলোমিটারের মধ্যে) স্থানভেদে রোপণ বা চাষ করা যেতে পারে। আম, জাম, কলা, লিচু পেয়ারা, ডালিম, নারিকেল, বেল, কমলা লেবু, ছোলা, সয়াবিন শিমূল ,কার্পাস, কাজু বাদাম ইত্যাদি।
মৌ কলোনির পরিচর্যা :
বিভিন্ন ঋতুতে মৌমাছির পরিচর্যাকে তিনটি ভগে ভাগ করা যায়। যেমন-মৌমাছির বংশ বৃদ্ধির সময়ে, যখন প্রকৃতিতে প্রচুর খাদ্য পাওয়া যায় তখন এবং খাদ্যসঙ্কট চলাকালে।
বংশ বৃদ্ধিকালে পরিচর্যা
বংশ বৃদ্ধিকালে রানী মৌমাছি যখন প্রচুর ডিম পেড়ে একটি মৌবাক্সে মৌমাছির সংখ্যা বাড়তে থাকে সে সময়টাই হল বৃদ্ধিকাল। এ সময় প্রকৃতিতে ফুলের সমারোহ দেখা যায় এবং মৌমাছিরা প্রচুর পরিমানে পরাগরেণু এবং ফুলের রস সংগ্রহ করে। বংশ বৃদ্ধিকালে বাচ্চাঘরে নতুন ফ্রেম দিতে হবে।
খাদ্য সঞ্চয়কালে পরিচর্যা
এ সময়ে প্রকৃতিতে প্রচুর ফুল পাওয়া যায়। মৌমাছিদের সংগ্রহীত পরাগরেণু বাচ্চা মৌমাছিদের খাওয়ানো হয়। ফুলের রস দিয়ে মৌমাছিরা মধু তৈরি করে মধুঘরের চাকে জমা করে। মধু রাখার স্থানের যাতে অভাব না হয় এজন্য মধু ঘরে আরও নতুন চাক দিতে হবে।
খাদ্য সঙ্কটকালে পরিচর্যা
এ সময়ে প্রকৃতিতে খাদ্য সংগ্রহ করার মতো ফুল খুব কম থাকে, ফলে মৌমাছিরা খাদ্য সঙ্কটে পড়ে। খাবারের অভাব মিটাতে এ সময় চিনির সিরাপ মিশিয়ে এই সিরাপ তৈরি করা হয়। যে পাত্রে সিরাপ পরিবেশন করা হবে সেটি বাঙ্রে ভেতরে রেখে সিরাপের পরে একটি কাঠি বা পাতা দিতে হবে, যাতে মৌমাছিরা তার ওপরে বসে রস খেতে পারে।
মধু সংগ্রহ
মধু সংগ্রহ করার সময় আস্ত চাক হাত দিয়ে চিপে মধু বের করা হয়। এ মধুতে মৌমাছির দেহাংশ ও বজ্য পদার্থ বিদ্যমান থাকে। এছাড়া এ ধরনের মধু অশ্প দিনের মধ্যে পচে নষ্ট হয়ে যায়। অপর দিকে বাক্সে লালন-পালন করা মৌমাছির চাক থেকে মধু নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্য মধু বের করা যায়। এতে চাক থেকে শুধু মধু বের হয়ে আসে, অথচ চাক নষ্ট হয় না এবং তা আবার ব্যবহার করা যায়।
মৌমাছি পালনের আয়-ব্যয়:
মৌমাছি পালন প্রকল্প স্থাপনের জন্য আলাদাভাবে কোনো জায়গার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আনাচে-কানাচে, ঘরের বারান্দায়, ছাদে কিংবা বাগানেও মৌ-বাক্স রাখা যায়। অ্যাপিস সেরানা প্রজাতির ৫টি মৌ-কলোনি সম্বলিত মৌ-খামার স্থাপনের জন্য মোট বিনিয়োগ হবে ১৫-১৬ হাজার টাকা। প্রতিবছর গড়ে প্রতি বাক্স থেকে ১০ কেজি মধু পাওয়া যাবে, যার বাজারমূল্য ২৫০ টাকা হিসেবে ২৫০০ টাকা। এ হিসেবে ৫টি বাক্স থেকে উত্পাদিত মধুর মূল্য দাঁড়াবে ৫–১০ কেজি – ২৫০ টাকা (প্রতি কেজি)= ১২,৫০০ টাকা। এই আয় ১০-১৫ বছর অব্যাহত থাকবে অর্থাৎ প্রথমে মাত্র একবার ১৫-১৬ হাজার টাকা ব্যয় করে প্রকল্প স্থাপন করলে মৌ-বাক্স এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি ১০-১৫ বছর ব্যবহার করা যাবে। আর কোনো বিনিয়োগ বা খরচ নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে অ্যাপিস মেলিফেরা প্রজাতির ৫টি মৌ-কলোনি সম্বলিত মৌ-খামার স্থাপনের জন্য মোট ব্যয় হবে ২৫ থেকে ২৭ হাজার টাকা। এক্ষেত্রেও ১০-১৫ বছর পর্যন্ত মৌ-বাক্স ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা যাবে। আর কোনো অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে না। মেলিফেরা প্রজাতির প্রতিটি মৌ-বাক্স থেকে বছরে ৫০ কেজি পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা সম্ভব, যার বাজারমূল্য ৫০ কেজি –২৫০ টাকা (প্রতিকেজি) – ৫টি বাক্স= ৬২,৫০০ টাকা। প্রকল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে মাত্র ২৫-২৭ হাজার টাকা এককালীন বিনিয়োগ করে প্রতিবছর ৬০ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে আয় করা সম্ভব। মৌ-বাক্সের সংখ্যা প্রতিবছর বৃদ্ধির মাধ্যমে এ আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। স্বল্প পরিশ্রমে এ ধরনের প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে একদিকে যেমন আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়া যায়, তেমনি পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় সহায়তা দানের মাধ্যমে দেশের ফল ও ফসলের উত্পাদনে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা দান করা যায়।
( মৌমাছি প্রতিপালন::তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)
এছাড়াও মৌমাছি প্রতিপালন সম্বন্ধে আরো তথ্য বাংলায় পড়তে ও জানতে নিচের দেওয়া লিঙ্কে যেতে পারেন—
(১) উইকিপিডিয়া
(২) Agriculture Learning
(৩) Vikaspedia
এইভাবে আপনি অপ্রক্রিয়াজাত মধু পেয়ে যাবেন।
এরপর মেশিনের সাহায্যে এই অপ্রক্রিয়াজাত মধুকে প্রক্রিয়াকরণ করতে হবে।
পদ্ধতি:
সাধারণত, মধু প্রক্রিয়াকরণের জন্য দুটি মেশিনের প্রয়োজন হয় – একটি ফিল্টার প্রেস মেশিন ও একটি ভ্যাকুয়াম বাষ্পীকরণকারী মেশিন।
প্রথমে আপনাকে একটি পরিষ্কার ইস্পাত পাত্রে এই অপ্রক্রিয়াজাত মধুটি ঢালতে হবে। এরপর ফিল্টার প্রেস মেশিনের সাহায্যে মধুতে জমে থাকা মোম ও ময়লা অপসারণ করতে হবে। তারপর ভ্যাকুয়াম বাষ্পীকরণকারী মেশিনের সাহায্যে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় মধু থেকে অতিরিক্ত জল-বাষ্প আলাদা করে নিতে হবে। এরপর আপনি ওজন মেশিনের সাহায্যে ওজন করে প্রতিটি বোতলে ভরে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠাতে পারেন।
মেশিনের দাম:
ফিল্টার প্রেস মেশিনের দাম প্রায় ১ লাখ টাকা ও ভ্যাকুয়াম বাষ্পীকরণকারী মেশিনের দাম প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়াও ওজন মেশিনের দাম প্রায় ৪,০০০ টাকা ও বোতল ভরার মেশিনের দাম প্রায় ২৫,০০০ – ৫০,০০০ টাকা।
অবশ্যই পড়ুন : নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে –
আপনার ব্যবসার জন্য উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন, লাইসেন্স ও মেশিন কেনার ঠিকানা